April 26, 2024

Bahumat

National News Paper of Bangladesh

‘কঠোর বিধিনিষেধের’ প্রথম দিনে হয়রানির শিকার চিকিৎসকরা

সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনে হয়রানির শিকার হয়েছেন চিকিৎসকরা। কঠোর বিধিনিষেধের এই সময়ে চিকিৎসকদের জন্য সরকারিভাবে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত গাড়িতে বা সিএনজিতে করে যাওয়ার সময় পুলিশের জেরার মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকী ব্যক্তিগত গাড়িতে করে হাসপাতালে আসার সময় চিকিৎসক পরিচয় দেওয়ার পরও পুলিশের কাছ থেকে মামলা খেয়েছেন—এমনটাও দাবি তাদের।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম। তার বাসা গ্রিন রোডে। মর্নিং শিফটে ডিউটি ছিল, নয়টা থেকে। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমাহলের সামনে ব্যারিকেড ছিল। তিনি বলেন, তারা বললো ‘যেতে পারবেন না, ঘুরে যান’। রাজাবাজার দিয়ে ঘুরে গেলাম। কিন্তু জাহাঙ্গীর গেটে পুলিশ আটকালে পরিচয় দিই। বলি যে ৯টা থেকে ডিউটি, হাসপাতালের পরিচয়পত্র দেখাই। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশ বলে, ‘কসাই গিরি ফলাস, তোর কসাইগিরি বাইর করতেছি, লাথি দিয়া পা ভাইঙ্গা দিমু’। নাম কী ছিল তার জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আসলে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এর জন্য। অভিজ্ঞতাও নেই। তবে উনি খুব ঊর্ধ্বতন কেউ ছিলেন না।

এই হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক কৃষ্ণা হালদার। চিকিৎসকদের বেশকিছু ব্যক্তিগত গ্রুপের একটিতে তিনি লিখেছেন, গতরাতে হাসপাতালে নাইট শিফটের ডিউটি ছিল। সকালে আমার গাড়িচালক আমাকে নিতে আসার সময়ে কাওরান বাজারে গাড়ি থামিয়েছে, চালক আমাকে আনতে আসছেন জানানোর পরও পুলিশ মামলা করেছে, সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে, গাড়িতে থাকা আমার আইডি কার্ড ছুড়ে মেরেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও গতকাল মুভমেন্ট পাস বের করতে পারিনি। তাহলে আমি কিভাবে কোভিড ডিউটি করবো—প্রশ্ন করেন তিনি।

আরেক চিকিৎসক বলেন, ২৪ ঘণ্টার ইমার্জেন্সি ডিউটিতে সকালে বের হলাম, আইডি কার্ড দেখানোর পরও রাস্তায় মোটামুটি যুদ্ধ করতে হলো পুলিশের সঙ্গে। তাহলে কিভাবে আমরা হাসপাতালে ডিউটি করবো, হাসপাতালগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হোক। নাহলে তো আমাদের তো ডিউটিতে আসতেই হবে। কার্ড দেখানোর পরও এক চেকপোস্টে রিকশা ঘুরিয়ে দিছে, আরেক পোস্টে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

চিকিৎসক রিয়াজ আহমেদ তমাল লিখেছেন, সকাল সাতটায় গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ গেট থেকে টঙ্গী স্টেশন রোডে পুলিশ আটকায়। তখন হাসপাতালের আইডি কার্ড দেখাই। পুলিশ উত্তর দেয়, আমাদেরও বের হওয়া নিষেধ। হাসপাতালে ডিউটি করতে হলে সেখান থেকেই করতে হবে এবং এটাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং।

করোনা ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্স জানান, এই হাসপাতালের আইসিইউর দায়িত্বে থাকা নার্সদের গাড়ি আটকায় পুলিশ। সে গাড়িতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্টিকার লাগানো ছিল। পুলিশ জানায়, মুভমেন্ট পাস ছাড়া গাড়ি ছাড়বে না।তিনি বলেন, আমরা কোভিড আইসিইউতে কাজ করি, অনেকবার বলার পরেও তারা গাড়ি আটকিয়ে রাখে। হাসপাতালে জানাই, দুঘণ্টা আটকে রাখার পর তারা গাড়ি ছাড়ে।

স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নাজমুল ইসলামের স্ত্রী চিকিৎসক ইসরাত জাহান তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ফেসবুকে। পোস্টের সঙ্গে তার স্বামীকে জরিমানা করা তিন হাজার টাকার স্লিপের ছবিও দিয়েছেন।

ইসরাত জাহান লিখেছেন, ‘আমার হাজব্যান্ড স্কয়ার হসপিটালের কোভিড ইউনিটে কর্তব্যরত। আজ সকাল ৮টা থেকে তার ডিউটি ছিল। আমাদের বাসায় আমার শ্বশুর কোভিড পজিটিভ হওয়ায় আমার হাজব্যান্ড বাসা (মুন্সিগঞ্জ) থেকে নিজেদের গাড়ি নিয়ে ডিউটিতে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরে। সকালে আমাদের গাড়ি সাইনবোর্ডের একটু পরে থামায় এবং ৩০০০ টাকা জরিমানা করে। আমার স্বামীর সঙ্গে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ড ছিল। স্কয়ার হসপিটালের ট্রান্সপোর্ট অবশ্যই মুন্সিগঞ্জ আসবে না। আর হঠাৎ করে একটা অ্যাপ বানিয়ে বললো, মুভমেন্ট পাস নিয়া বাইর বের হবেন যেখানে তাদের ওয়েবসাইটেই ঢোকাই যায় না। এমতাবস্থায় ডাক্তাররা কি সারাদিন ডিউটি বাদ দিয়ে পাস পাস খেলবে নাকি?’

চিকিৎসকদের হয়রানি ও জরিমানার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ( বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশের ওপরমহল এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে আমরা আলাপ করেছি। পুলিশের সিনিয়র অফিসাররা আমাদের বলেছেন, ‘পুলিশের মাঠ পর্যায়ের বাড়াবাড়ি এগুলো’। তাদেরকে বলাই হয়েছে এবং সবাই জানে, সব হাসপাতাল খোলা। বরং কোনও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর যদি হাসপাতাল বা কর্মস্থলে যেতে অসুবিধা হয় তাদের পুলিশের গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে।

মাঠ পর্যায়ের ওনারা যখন একটু ক্ষমতা পান, তারা বাড়াবাড়ি করেন, এটাই মনে হচ্ছে—বলেন ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী।

চিকিৎসকদের সারাদিন হয়রানি করা হয়েছে এবং এটা করেছেন পুলিশের অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা বা কর্মচারী জানিয়ে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ (এফডিআরএস) এর মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করেছে। তারা চিকিৎসকদের হয়রানি করেছে, কাউকে কাউকে জরিমানা করেছে। এটা আসলে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। যেই মুহূর্তে চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনে যাচ্ছেন সেখানে এই হয়রানি তাদের জন্য উদ্বেগজনক। আমরা আশা করি, যারা এই ধরণের কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

চিকিৎসকদের হয়রানির কথা স্বাস্থ্য অধিদফতরে ইতোমধ্যেই আলোচনা হয়েছে জানিয়ে অধিদফতরের পরিচালক ( হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটা আমরা শুনেছি, ডিজি স্যারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।কাল এ বিষয়ে সবাই মিলে এ বিষয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাদেরকে হয়তো সবাইকে পাস দিয়ে দেওয়া হবে যেন আর ডিস্টার্ব না করে।

জরুরি সেবার আওতায় চিকিৎসকরা থাকলেও কেন এমন হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুজন চিকিৎসক এর ঘটনা আমি শুনেছি। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কী কারণে মামলা করা হলো এসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। যেসব বিভাগে এই মামলাগুলো করা হয়েছিল সেসব বিভাগের সংশ্লিষ্ট ডিসিদের জানানো হয়েছে মামলাগুলোর ফাইন মওকুফ এর জন্য। মূলত সমস্যা হয়েছিল ডাক্তাররা যখন এসেছেন তারা তাদের নিজস্ব গাড়িতে এসেছেন এছাড়া ভাড়া বাড়িতে এসেছেন। যে কারণে চালকরা ডাক্তারদের এই বিষয়গুলো মাঠে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।