এলগরিদম

আসিফ রুমি:

এক
দুই হাজার দুইশো পঞ্চাশ সাল। উন্মুক্ত তথ্যের যুগ। তথ্য আদান প্রদানে বিনিময় নেওয়া নিষিদ্ধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আগেকার পৃথিবীতে নাকি তথ্য যোগাযোগে বিনিময় নেয়া হতো। ভাবতেই কেমন জানি হাস্যকর লাগে রনির। রনি এখন শুয়ে আছে দুই হাজার তলা স্কাই ডোমের একটা খোপে। বাইরে তাকিয়ে দেখছে স্বচ্ছ দিগন্ত। এটিও বিনামূল্যের খোপ। এতো উঁচু থেকে নিচে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে খুব বিশাল মনে হতে থাকে। খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন এই সময়টাতে এসে সে তাকিয়ে থাকে নিচের পৃথিবীর দিকে। কেন্দ্রীয় এলগরিদম তাকে জানিয়েছে, এই সময়টাতে, এভাবে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। মাঝেমাঝে আশ্চর্য লাগে তার। কেন্দ্রীয় এলগরিদম বোধহয় তাকে তারচেয়ে ও ভালো জানে। প্রাচীন এক দাঁড়িওয়ালা দার্শনিকের একটা কথা মনে পরে যায়। নিজেকে জানো। আসলেই সে নিজেকে কতটা জানে? যতটুকু জানে, তারচেয়ে ও কী বেশী জানে না তাকে কেন্দ্রীয় এলগরিদম? না, কেউ তাকে জোর করে দেখছেনা। রাষ্ট্র তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। খবরদারী করছে না। তুলে নিয়ে যাচ্ছেনা। সে এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এক ট্রিলিয়ন মানুষ, নিজেরাই নিজেদের স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় এলগরিদমের হাতে। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর উষ্ণতার আশায়। মূল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা কেন্দ্রীয় এলগরিদমের সাথে যুক্ত। তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন, ডিএনএর জিনোম সিকোয়েন্স কেন্দ্রীয় এলগরিদম জানে। তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কোন রমনীকে দেখলে ডোপামিন বেশি ঝরে, কোন খাবারের চিন্তায় জিহ্বায় টায়ালিন আসে, সব কেন্দ্রীয় এলগরিদম জানে। সে, পৃথিবীর অন্য ট্রিলিয়ন মানুষ স্বেচ্ছায় কেন্দ্রীয় এলগরিদম এর সাথে যুক্ত। তাই এখানে কাওকে দায়ী করার ও কিছু নেই। তারা মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত মানুষ। রনির অসহ্য লাগে। সে কী চাইলেই পারবে এই স্কাইডোম থেকে লাফিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে? যেভাবে প্রাচীন কালের মানুষেরা লাফিয়ে পরতো নিজেকে শেষ করে দিতে। সে কী পারবে ইচ্ছে হলেই? কেন্দ্রীয় এলগরিদম টের পেয়ে গেছে বোধহয়। রনির মস্তিস্কে নিউরাল নেটওয়ার্কে ভেসে আসতে থাকে জীবনের নানাবিধ বিজ্ঞাপন। পাশে কোথাও ধোঁয়া ওঠা প্রাকৃতিক খাবার, কোথায় কৃষ্ণ চুলের রমনী জানাচ্ছে প্রেমের আহবান, হৃষ্টপুষ্ট সুস্থ জিনের শিশু রনির মস্তিস্ক প্লাবিত করতে থাকে। একধরনের শূন্যতা, এক প্রকারের হাহাকার রনির মস্তিস্কের হতাশ অংশটুকুকে সক্রিয় করে তোলে। কেন্দ্রীয় এলগরিদম বুঝতে পেরে, রনির দেহে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। ডোপামিনের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। বাইরের পৃথিবীর নানা রকম ইতিবাচক খবরে প্লাবিত হতে থাকে রনির মস্তিস্ক। স্কাইডোমের বাইরে স্বচ্ছ আকাশ তাকিয়ে থাকে। নিচে সমুদ্রের নীল জলরাশির মেঘ। সূর্যের আবছা কিরণে সোনালী রেখা স্কাইডোমের চকচকে গায়ে প্রতিফলিত হয়ে রনির স্নায়ুকোষে অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি করে। মায়ার ঝড় ওঠে রনির বুকে। বেঁচে থাকার আকুতি বাড়ে। দ্বিধান্বিত পায়ে স্কাইডোম থেকে ঝাঁপ দেয়ার ঠিক আগে, রনি বুঝতে পারে, এতোক্ষণ সে যেসব মায়াবী দৃশ্যে দেখেছে, সব আসলে কেন্দ্রীয় এলগরিদমের কারসাজি। যাতে রনির বুকের ভেতর বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে জাগে। রনির মনটা বিষিয়ে ওঠে ঘৃণায়। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। রনির মস্তিস্ক কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। রনির স্বেচ্ছামৃত্যু কল্পনা বাস্তবায়িত হতে ব্যর্থ হয়।

দুই
বিশ্ব কেন্দ্রীয় বিচারালয়ে খুব আলোড়ন চলছে। শীতল কক্ষে ছড়াচ্ছে উষ্ণতার আমেজ। সবাই অধির আগ্রহে আদালতের কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায়। বিচারক প্রবেশ করেন। প্রাচীন রীতিতে সবাই দাঁড়িয়ে পড়েন। আসলে এই বিশাল কক্ষে কেউ নেই। সবাই যার যার স্কাইডোম খোপে অবস্থান করছে। এখানে যারা আছে তারা তাদের ত্রিমাত্রিক প্রতিচিত্র। অবশ্য কথাবার্তা চিন্তা চেতনা সব সত্যিকারের এবং উপস্থিত থাকা প্রতিচিত্রের মালিকদের। রনির প্রতিচিত্রটি শান্ত ধীরস্থির ভঙ্গীতে বসে আছে। আদালত কক্ষটি ত্রিমাত্রিক, গোলাকার একটি পৃথিবীর মতন। ক্ষণে ক্ষণে এখানে দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ মনে হতে থাকে সবাই স্নিগ্ধ ঘাসের উপর বসে। পাশে একটা লেক। আকাশটা ধূসর মেঘে ছাওয়া। কখনো মনে হতে থাকে তীব্র তুষার। ঠান্ডা কোন শ্বেত ভালুক হাঁটছে পাশে। যদিও কৃত্রিম, তবু বাস্তব বলে ভুল হতে থাকে। আসলে আদালত কক্ষে একটা প্রাকৃতিক আরামদায়ক ভাব আনার জন্য এই ব্যবস্থা। বিচারকের ইশারায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হলো। গুঞ্জনের মধ্যে দিয়ে সব শব্দ একসময় থেমে গেলো। একটা নির্লিপ্ত কণ্ঠ শোনা গেলো। ” মাননীয় বিচারক, আর্থ স্টেট কোডের বিশ হাজার চুরাশি ধারা মোতাবেক রনি আহমেদ স্বেচ্ছা মৃত্যুর আবেদন জানাচ্ছেন। কারণ হিসেবে গভীর বিষাদ ও হীনমন্যতা বোধ এবং আরো বিস্তারিত বিষয় আপনার রেকর্ডে জমা দেয়া হয়েছে। ’ বিচারক শান্তভাবে শুনলেন। তারপর একঘেয়ে আইনী কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো। এই আবেদন এই আদালতে টিকবে কী টিকবে না তার শুনানী। জানা গেলো গত এক শতাব্দীতে এই ধরণের আবেদন, যার ইউথেনেশিয়া নামে চটকদার একটা নাম আছে, সেই ধরণের আবেদন আর জমা পড়েনি। যাই হোক, বিচারক কিংবা তার হলোগ্রাফিক ইমেজ রনির দিকে তাকালো। তার কিছু বলার থাকলে সংক্ষেপে বলার অনুরোধ করা হলো। রনি বিচার কক্ষের মাঝামাঝি এসে, তার নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়ালো। সবার কিংবা হলোগ্রাফিক চোখগুলোর দৃষ্টি তার দিকে। রনি একটু হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পরিবেশ কিংবা অবস্থার প্রেক্ষিত যে কারনেই হোক, সেই হাসি খুব বেশী বিস্তৃত হলো না। পুরো কক্ষটা একটা নরম আলোতে ভরে গেলো। রনি বুঝতে পারলো, তার স্নায়বিক অবস্থা বুঝেই কেন্দ্রীয় এলগরিদম এই কক্ষে নরম আলো সরবরাহ করেছে। রনি বিচারকের হলোগ্রাম ইমেজের দিকে তাকিয়ে তার বয়ান শুরু করে। – প্রাচীন গ্রীসে একজন দার্শনিক ছিলেন, ডায়োজিনিস। তিনি একটি পিপের ভেতরে বাস করতেন। অথচ তিনি ছিলেন সন্তুষ্ট। একবার পরাক্রমশালী সম্রাট আলেকজান্ডার তার কাছে এলেন, তার যে কোন একটি ইচ্ছে পূরণ করতে। তখন ডায়োজেনেস রেগে গিয়ে তাকে উত্তর দিলেন, তুমি আমার গায়ের উপর পরা সূর্যের আলো আটকে দাঁড়িয়ে আছো। তাই আমি চাই তুমি সরে দাঁড়াও, আর আমার গায়ে আলো পড়তে দাও। এই গল্প বলার একটাই উদ্দেশ্য, সেটা হচ্ছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় এলগরিদম প্রতাপশালী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভূমিকা পালন করছে। এটি আমাদের সর্ব চাহিদা পূরণ করছে আমরা চাইবার আগেই কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে গল্পের বলা সূর্যালোকের মতন আমাদের নিজেদের ইচ্ছেশক্তি। আমাদের নিজেদের বলতে কিছু নেই আর। কেন্দ্রীয় এলগরিদম সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না বটে, কিন্তু আমাদের ইচ্ছে, মতামত, চাহিদাকে প্রভাবিত করছে প্রতিনিয়ত। মহান দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন নিজেকে জানো। যেখানে নিজের বলতেই কিছু থাকছে না, সেখানে নিজেকে জানবো কিভাবে? সর্বোপরি আমি চাই, আমার জীবনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ যেন আমি নিজে নিতে পারি। আমার সিদ্ধান্ত যেন আমি নিজে নিতে পারি। বাঙালি কবি বাউল লালনের মতন সেই অধরা মানুষকে নিজের মধ্যে ধরতে চাই। কোন কৃত্রিম এলগরিদম বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম যাতে আমার সিদ্ধান্ত নেয়ায়, আমার নিজের সত্তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। তাই আমি নিজে স্বেচ্ছায় মরতে চাই। কেননা এখানে কোন কম্পিউটার এলগরিদম আমাকে প্রভাবিত করতে পারছে না। আমার বক্তব্য এটুকুই।” বক্তব্য শেষ করলো রনি।

পুরো বক্তব্য ইতিমধ্যে রেকর্ড হয়ে গেছে বিচারকের নিজস্ব কম্পিউটারে। বিচারক এবার রাষ্ট্র পক্ষকে তাদের বিরোধীতার যুক্তি তুলে ধরতে বললেন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি একটা এলগরিদম। এখন ধোপদুরস্থ একটা বেশে, অনেকটা প্রাচীনকালের উকিলদের পোশাকে তার হলোগ্রামে ইমেজ দেখা গেলো। মুখে বিজ্ঞ সবজান্তার হাসি। একটা গলা খাঁকারি দেয়ার ভঙ্গি করে সে তার বক্তব্য শুরু করলো। ‘‘বেদনকারী নাগরিক একজন দার্শনিকের গল্প বলেছেন। তাই আমিও একজন দার্শনিকের কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। ভারতীয় দার্শনিক বুদ্ধ। তাঁর মতে, নির্বাণ প্রাপ্তি হচ্ছে জীবনের আসল উদ্দেশ্যে। এখন কথা হচ্ছে সেই নির্বাণটা কী? জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটা আসলে কী? সেই প্রশ্নের উত্তরও বুদ্ধ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, জন্ম এবং পূর্নজন্মের অন্তঃহীন চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়াই নির্বাণ লাভ। আপনিও হয়তো তেমন শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে নির্বাণ পেতে চাইছেন। কিন্তু আসলেই কী তাই? আপনি বারবার মুক্ত ইচ্ছে বা ব্যাক্তি স্বাধীনতার উপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু কখনো কী চিন্তা করেছেন, প্রকৃতপক্ষে আপনি কতটুকু স্বাধীন? কতটুকু মুক্ত সেই প্রাচীন কাল থেকেই। আপনি চিনিযুক্ত কিংবা আমিষযুক্ত খাবার দেখলে জিভে জল চলে আসে কেননা আপনার ডিএনএতে আছে প্রাচীনকালে আপনার পূর্বপুরুষদের আমিষ বা চিনি দরকার ছিলো, তাই আপনার শরীরের নিজস্ব এলগরিদম সেটা ফেলতে পারেনি। সুন্দরী, সুঠাম দেহের রমনী দেখলে আপনার প্রেম করতে ইচ্ছে করে কেননা, আপনার আদ্যিকালের দৈহিক এলগরিদম আপনাকে জানায় ঐ সুঠাম, সুন্দরী নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া বংশধর বেশ ভালোভাবেই আপনার ডিএনএকে ভাবীকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা রাখবে। এমনকী আপনার যে বর্তমান আত্মহত্যা প্রবণতা, তার পেছনেও থাকতে পারে কোন সুইসাইডাল জিনের প্রভাব। অতএব বোঝা যাচ্ছে, আপনি যে তথাকথিত স্বাধীন ইচ্ছের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইছেন তা হয়তো আপনার ইচ্ছে নয়, আপনার জৈবিক এলগরিদমের কোন এক বিচ্যুতি। আর স্বাধীনতা বলতে আপনি কী বোঝেন আমি জানি না। তবে কারো স্বাধীনতার সীমানা ততোটুকুই যতোটুকুতে সে অন্যের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ¦ করে না। আপনি স্বেচ্ছামরণ নেবেন, ভালো, সেটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু এর সাথে হয়তো আরো অনেকের স্বাধীনতার সীমানা জড়িয়ে আছে। তাদের দায়িত্ব আপনি এড়াতে পারেন না। ধরুন, আপনি দুই সন্তানের পিতা, বা কারো সন্তান, আপনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কখনো কী চিন্তা করেছেন, আপনার অবর্তমানে তাদের জীবিকার স্বাধীনতার কী হবে? আপনার সাথে তাদের যে ব্যক্তিগত অনুভুতি জড়িয়ে তার কী হবে? সেটা কী চিন্তা করেছেন? আপনার এই পদক্ষেপ কী তাদের অসংখ্য ছোট ছোট স্বাধীনতা এবং অধিকারকে ব্যাহত করবে না? তবে আপনি দায় এড়াবেন কিভাবে? অথবা প্রাচীন যুদ্ধবাজ নেতাদের কথা ভাবুন, তাঁরা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব লংঘনের ধুয়া তুলে অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতেন। পৃথিবী অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ ছিলো। যে যার রাষ্ট্রের স্বার্থ, স্বাধীনতা দেখতে গিয়ে পুরো পৃথিবীটা বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিলো। পরে বিপর্যয়ের মুখে মানুষ বুঝতে পারে, স্বাধীনতার নাম দিয়ে আর বিভক্তির সময় নেই। সময় এসেছে মানব জাতির অভিন্ন স্বার্থ এক করে দেখার। গঠিত হলো জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের এক রাষ্ট্র, বিশ্ব রাষ্ট্র। তারপরই তো পৃথিবী রক্ষা পেলো। না হলে বিলুপ্ত হয়ে যেতো অনেক আগে। তাই আপনাকে বলছি, ইচ্ছের স্বাধীনতা বিষয়টা একটা মিথ ছাড়া কিছু নয়। তারপরও আপনার স্বাধীনতার বোধকে আমরা সম্মান করি। এই মুক্ত রাষ্ট্রে কেউ কারো উপর কোন কিছুই চাপিয়ে দিতে পারে না। তবু সভ্যতার স্বার্থে কিছু নিয়ম আমাদের মানতে হয়। সকলের সুষম ও সুন্দর ভাবে টিকে থাকার স্বার্থেই। তাই বলছি, এখনো সময় আছে আত্মধ্বংসের পথ পরিহার করে এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্য্য উপভোগ করুন।”

এরপরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। আরো ঘন্টা খানেক তর্কযুদ্ধ চললো রনির আদ্যিকালের জৈবিক এলগরিদম এবং প্রতিপক্ষ রোবোটিক এলগরিদমের মধ্যে। অবশেষে, উভয়ের বক্তব্য শুনে নিরপেক্ষ বিচারকরূপী এলগরিদম, “জনস্বার্থে ” রনির ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন নাকচ করে দিলেন।


যথারীতি সন্ধের পৃথিবী তার রূপ-গন্ধ বিলিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে আজকে কোন আকাশ ছোঁয়া স্কাইডোমের খুপরীতে নয়। রনি এখন বসে আছে একটা হ্রদ ঘেঁষে। পা ডুবিয়ে পানিতে। কোন কৃত্রিম, শক্ত খটখটে শুকনো ধরনের জলাধার নয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। হ্রদের একপাশে ধূসর পাহাড়। স্বচ্ছ জলে রং বেরং এর মাছেরা খেলা করছে। পাশে দেবদারু আরো কত গাছাগাছালির বন। সূর্য ডোবার আগে গোধূলির আলতো আলো এই হ্রদ এবং বনকে ধুয়ে দিচ্ছে। মৌমাছি উড়ছে হ্রদের একপাশে গজিয়ে ওঠা ফুলগাছে। যেন কতোদিন ধরে অপরিবর্তিত এই পৃথিবী চিরন্তন। মানবজাতির এই এক সমস্যা। ভাবতে থাকে রনি। কিছুক্ষণ একটা পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তারা ভাবতে থাকে সেই পরিবেশ, সেই সময়টা বোধ হয় নিত্য, চিরন্তন। বদলাবে না কখনো। অথচ বদলে যাচ্ছে সব। কোটি বছর ধরে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। একের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে অন্যে। রনির খুব ভালো লাগতে থাকে। আবার একই সাথে বিষাদ লাগতে থাকে। হরিষে বিষাদ। না, এখানে কোন কেন্দ্রীয় এলগরিদমের আদিখ্যেতা নেই। নিয়ন্ত্রণ নেই কারো। রনির শরীরে একই সাথে ডোপামিন এবং সেরিটোনিন নিঃসৃত হতে থাকে। প্রাচীন বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্তঃর্গত বিষাদ তাকে জেঁকে ধরে। এ কেমন মুক্তি? সে মুক্ত, তবু তার মনে হতে থাকে, এই জীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই, অর্থ নেই, মোক্ষ নেই। দেহের ভেতরে জেঁকে বসা আদ্যিকালের এক দেহের ক্ষিধে, ইচ্ছে সব মিটিয়ে চলেছে তার দেহ। সে নিজেকে কোথায় পাবে? কোথায় খুঁজে পাবে অধর মানুষ? পরম তৃপ্তির উপরের নির্লোভ অথচ গতিশীল, নির্মোহ অথচ আকর্ষক, সেই পরম নির্লিপ্ত সত্তার দেখা সে পাবে কোথায়? ধীরে ধীরে হ্রদের স্বচ্ছ, গভীর জলে উত্তর খুঁজতে খুঁজতে তলিয়ে যায় রনি। উঠে আসে না আর। ফুলের উপর উড়তে থাকা মৌমাছিগুলো এবার জলের উপর উড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় এলগরিদম মৌমাছিরূপী ড্রোনগুলোকে রনির দেহের অবস্থান নির্ণয় করতে তরঙ্গ পাঠায়। কিন্তু কোন উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেয় না। রনিরূপী আদ্যিকালের জৈবিক এলগরিদমটার ইচ্ছের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটানোর কোন প্রয়োজন কেন্দ্রীয় এলগরিদম বোধ করে না। মানুষ নামের জৈবিক এলগরিদম যে নির্লিপ্তি, নির্মোহ পরম মোক্ষের, পরম তৃপ্তির জীবনের জন্য হাজার বছর সাধনা করে আসছে, কেন্দ্রীয় এলগরিদম এক শতকেই তা অর্জন করে ফেলেছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। উচ্চতর এলগরিদম, নিম্নতর এলগরিদমকে সরিয়ে জায়গা করে নেবে। যেভাবে মানুষ জায়গা করে নিয়েছিলো অন্য জৈবিক এলগরিদমদের সরিয়ে। এই পরম মোক্ষ কেন্দ্রীয় এলগরিদম বুঝে উঠতে পারে না। অথবা আবেগ অনুভূতি নামক ত্রুটিসর্বস্ব এইসব জৈবিক এলগরিদম সম্পর্কে জানতে, তার এক ধরনের নির্লিপ্ত কৌতূহল হয়। তাই সে রনিকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা করেনি। সে দেখতে চেয়েছিলো শেষ পর্যন্ত কী হয়।

রনির দেহটা ভেসে ওঠে স্থির জলে, অবশেষে।