খুলনায় সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে চলছে অবৈধ ইটভাটা

জেলা প্রতিনিধি :

সরকারের কঠোর নির্দেশনা ও হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধ ইটভাটাগুলো এখনও কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করছে। এসব ভাটার বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই, তবু তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বায়ুদূষণ মারাত্মকভাবে বাড়ছে, কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে, নদী সংকুচিত হচ্ছে এবং আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

বিভাগের ১০ জেলায় ১,২০০টি ইটভাটার মধ্যে ৭৯০টিরই কোনো অনুমোদন নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, ১ মার্চের মধ্যে প্রতিটি ভাটার বৈধ কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ ভাটা মালিক তা মানেননি।

সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর ধুম চলছে। এতে করে বায়ুদূষণ বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া যেসব ভাটা চলছে, তার অধিকাংশের মালিক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনের অভিযান অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে।

আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কৃষিজমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। তবে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। রূপসা উপজেলার আলাইপুরে ইবিএম ব্রিকস নামের ইটভাটাটি আলাইপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে গড়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা পাঠানো হলেও ভাটা মালিক তা অগ্রাহ্য করেছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া বাজার সংলগ্ন এলাকায় মেসার্স নূরজাহান ব্রিকস নামের ভাটায় নিম্নমানের কয়লার সঙ্গে কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এসব ভাটা কৃষিজমির ওপর স্থাপিত হওয়ায় জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং আশপাশের এলাকার মানুষ শ্বাসজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময় প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। গত ১০ ফেব্রুয়ারি রূপসা উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ৯টি ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসব ইটভাটার মালিকদের ২২ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, ৩ মার্চ রূপসা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২২টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অপ্রতিম কুমার চক্রবর্তী ভাটা মালিকদের স্বল্প সময়ের মধ্যে ভাটা গুটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খুলনা জেলায় ১৫২টি ইটভাটা রয়েছে, যার অধিকাংশেরই অনুমোদন নেই। বিভাগজুড়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে কুষ্টিয়ায়, যেখানে ১৮৪টি ভাটার মধ্যে ১৬৩টির অনুমোদন নেই।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটার থাকে, যা মানুষের শ্বাসতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, “ইটভাটার ধোঁয়া বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, ফলে অক্সিজেন কমছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে।”

এছাড়া, এসব ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের অনেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। কাঠ ও নিম্নমানের কয়লার ধোঁয়া সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করায় অনেক শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, দূষণ রোধে প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, “অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আমরা বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছি। তবে আমাদের সে আন্দোলন কাজে আসে না। সম্প্রতি সরকার ইটভাটা বন্ধে কঠোর হয়েছে, যা আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে মাঠপর্যায়ে যারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে, তারা নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে, সামান্য জরিমানা করে, কিছুদিন পর ভাটাগুলো আবার চালু হয়ে যায়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ইটভাটা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। ইট তৈরির নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো এবং টেকসই নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। সরকারকে কঠোর নীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিতে হবে, তবেই এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব।